প্যপিরাসে আঁকা ক্লিওপেট্রা
সকাল সাতটা আমরা দুজন হোটেল থেকে ঠিক করে দেয়া প্রাইভেট কারে করে কায়রো থেকে ২২৫ কিমি দুরে ভূমধ্যসাগরের তীরে ইতিহাস বিখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়া নগরী দেখতে যাচ্ছি। যেখানে পৃথিবীর প্রাচীনতম সপ্তাশ্চর্যের একটি আশ্চর্য সেই বাতিঘর যে কিনা বছরের পর বছর ধরে অথৈই সাগরে দিক ভ্রান্ত নাবিকদের দেখিয়ে গেছে তীরের নিশানা। ভুমধ্যসাগরের মুক্তো বলে বিশ্বজুড়ে যার খ্যাতি।
তরঙ্গ বিক্ষুদ্ধ ভুমধ্যসাগরের তীরে আলেকজান্দ্রিয়া নগরী
এ সমস্ত পরিচয় ঢেকে গেছে তার আরেকটি পরিচয়ের কাছে তা হলো,
আলেকজান্দ্রিয়া সেই ভুবন বিখ্যাত রূপের রানী, আজ পর্যন্ত সৌন্দর্যের চুড়ান্ত প্রতীক হিসেবে চিন্হিত ইজিপ্টের শেষ ফারাও ক্লিওপেট্রার সাম্রাজ্যের রাজধানী। যাকে কেন্দ্র করে কত ঘটনার জন্ম, কত ইতিহাস, কত প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, কত কাহীনি।
টানা সোজা, ঝকঝকে চওড়া হাইওয়ে , কোনো আকাবাকা নেই, দুপাশে কখনো ছোটো ছোটো শহর কখনও বা খেজুরের বিথী। আলেকজান্দ্রিয়া নগরীটি নীল নদের বদ্বীপে অবস্থিত বলে বেশ একটু সবুজ ভাব। মোটামুটি খালি সেই রাস্তায় ১২০/১৪০ কিমি গতিতে গাড়ী চলছে একটানা সামনের দিকে। আস্তে আস্তে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি শহরের প্রধান প্রবেশ দ্বারের দিকে।
বর্তমান আলেকজান্দ্রিয়া নগরীর প্রবেশ দ্বার
আর আমার মন যেন আরও দ্রতগতিতে পিছনের দিকে ছুটে চলেছে। মনে পড়ছে গ্রীসের একটি ছোট্ট নগর রাস্ট্র মেসিডোনিয়া জন্ম নেয়া সেই দিগ্বিজয়ী যুবক সম্রাট আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেটের কথা, যার কাছে পদানত হয়েছিল তিন তিনটি মহাদেশ।
৩৩২ খৃঃ পুঃ এ মিশর দখল করে ভুমধ্যসাগরের তীরে আলেকজান্ডার তার নিজ নামের সাথে মিলিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া নামে এই রাজধানী শহরটি প্রতিস্ঠা করেছিলেন। কিন্ত তার অকাল মৃত্যুর ফলে উত্তরাধিকারী না থাকায় তিন মহাদেশ জুড়ে থাকা তার এই বিশাল সাম্রাজ্য ভাগ হয়ে যায় তিন সেনাপতির মধ্যে। মিশর পড়েছিল তারই একজন প্রিয় সেনাপতি টলেমীর ভাগে।
গ্রীক আমলে তৈরী আলেকজান্দ্রিয়া নগরীতে স্ফিংক্স
সেই সেনাপতি টলেমী যিনি পরবর্তিতে ইজিপ্টের ফারাও তারই বংশধর ক্লিওপেট্রা ছিলেন স্বভাবতঃই জাতিতে গ্রীক। তাইতো আমার গাইডের কাছে যখন জানতে চেয়েছিলাম, 'কে বেশী সুন্দরী ক্লিওপেট্রা না নেফারতিতি'? তাচ্ছিল্যভরে সে উত্তর দিয়েছিল, "ক্লিওবাত্রা ওয়াজ নট ইজিপশিয়ান, শি ওয়াজ গ্রীক"। এ সমস্ত জিনিসগুলো আমাকে ভীষন কৌতুহলী করে তুলেছিল আমার জানা জিনিসগুলোকে আরও ভালো করে জানতে।
৬৯ খৃঃ পূঃ এর জানুয়ারী মাসে মিশরের তৎকালীন রাজধানী আলেক্জান্দ্রিয়ায় ফারাও দ্বাদশ টলেমী ও মা ক্লিওপেট্রা এর কোল আলো করে জন্ম নেয় কিম্বদন্তীর সৌন্দর্যের রানী ক্লিওপেট্রা থিও ফিলোপেটার।আজও সে বিনা প্রতিদ্বন্দীতায় পৃথিবীর সেরা সুন্দরী হিসেবে বিবেচিত। তাঁর সিংহাসন টলে গিয়েছিল, কিন্ত সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে তার আসন কেউ টলাতে পারেনি।
ক্লিওপেট্রা ছবিতে নাম ভুমিকায় এলিজাবেথ টেলর
৫১ খৃঃ পূঃ এ দ্বাদশ টলেমী মারা গেলে জেস্ঠ সন্তান হিসেবে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হলেন ক্লিওপেট্রা, কিন্ত মিশরীয় রীতি অনুযায়ী কোনো মেয়ে সন্তান এককভাবে ফারাও হতে পারবেনা । ফলে তার ছোটোভাই ১২ বছরের অস্টম টলেমী কে সঙ্গী মতান্তরে বিয়ে ( তখনকার রীতি অনুযায়ী) করে যৌথভাবে সিংহাসনে আরোহন করেন আঠারো বছরের ক্লিওপেট্রা। সে সময় তার মতন এক অল্পবয়সী রানীর পক্ষে রাজ্য পরিচালনা করা এত সোজা ছিলনা। কারন ঐ সময় পরাক্রমশালী রোমানরা একের পর এক শহর দখল করে প্রায় পুরো মিশরের নিয়ন্ত্রনের ভার নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল। নিজের সাম্রাজ্য রোমান মুক্ত রাখা একটা কঠিন সংগ্রামে পরিনত হয়েছিল তার জন্য। শুধু রোমানই নয় নিজেদের মধ্যেও আন্তকোন্দলও ছিল। নয়টি ভাষায় অনর্গল কথা বলার দক্ষতা ছাড়াও অসম্ভব বুদ্ধিমতী ও কুশলী ক্লিওপেট্রা তার বিভিন্ন গুনাবলীর জন্য রাজ দরবারের অনেকেরই হিংসার পাত্রী হয়ে উঠেছিলেন।
পাথরের ভাস্কর্যে ক্লিওপেট্রা
ক্লিওপেট্রার শাসনকালের প্রথম তিনবছরে ক্রমাগত এক একটি বিপর্যয় ঘটছিল,যেমনঃ অর্থনৈতিক মন্দা, দুর্ভিক্ষ, নীল নদের বন্যা ছাড়াও নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ ইত্যাদি। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এ সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে তাকে অবিরত কঠিন সংগ্রাম করতে হচ্ছিল। এছাড়াও সে তার ভাই তথা স্বামীর সাথে যৌথ নেতৃত্বেও সন্তষ্ট ছিলেন না। যে কারনে সে বিভিন্ন রাজকীয় নথিপত্র এমন কি মুদ্রা থেকেও তার ভাইয়ের নাম বিলুপ্ত করে তার নিজ নামে একক মুদ্রা প্রবর্তন করেন। তার এসব কাজে তার অনেক পারিষদই অসন্তষ্ট হয়ে উঠে।
শেষ পর্যন্ত তারই পিতার এক পরামর্শদাতার ষড়যন্ত্রে তিনি সিংহাসনচ্যুত হয়ে সিরিয়া পালিয়ে যান। এর পর তার ছোটো ভাই একক ভাবে ইজিপ্টের সিংহাসনে আরোহন করলে ক্লিওপেট্রা তা সহজ ভাবে নিতে পারেনি এবং এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন।
শীল্পির তুলিতে আকা জুলিয়াস সীজার
ক্লিওপেট্রা জানতো যে তার ভাইয়ের শত্রু রোমান সেনাপতি জুলিয়াস সীজার তখন আলেকজান্দ্রিয়া অবস্হান করছেন। সে সীজারেরর সাথে দেখা করে সিংহাসনের উপর তার দাবীর কথা জানানোর জন্য একটি আবেদন পেশ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্ত সীজারের সাথে দেখা করাটা এত সোজা ছিলনা। ক্লিওপেট্রা জানতো সে যদি প্রকাশ্যে শহরে প্রবেশের চেস্টা করে তবে ভাইয়ের হাতে তার মৃত্যু অনিবার্য। তার ফলে সে এক অভিনব কৌশল গ্রহন করেন।
কার্পেট থেকে বেরিয়ে আসা রূপের রানী ক্লিওপেট্রা
অসম্ভব চতুর ও বুদ্ধিমতী ক্লিওপেট্রা নিজেকে প্রাচ্য দেশীয় এক কার্পেটে মুড়িয়ে তার সঙ্গীদের মাধ্যমে সীজারের সামনে কার্পেট টাকে উপঢৌকন হিসেবে পেশ করেন। এরপর ক্লিওপেট্রার সঙ্গীরা পুর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সীজারকে দেখানোর জন্য গোল করে মোড়ানো কার্পেটটার এক মাথা ধরে এক টানে সেটাকে খুলে ফেল্লে তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে বিশ্বের বিস্ময়, অবর্ননীয় সৌন্দর্যের প্রতীক, ইজিপ্টের সিংহাসন থেকে বিতাড়িত, নির্বাসিত রানী ক্লিওপেট্রা।
বিখ্যাত সেনাপতি জুলিয়াস সীজার, রোমান সাম্রাজ্যের অধিপতি ,বহু যুদ্ধের বিজেতা সেই রাস্ট্রনায়ক বিস্মিত নয়নে চেয়ে থাকে কার্পেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা সেই একুশ বছরের বিস্ময়ের দিকে...
রোমান সিনেটে সঙ্গীদের সাথে সীজার
কুশলী রাস্ট্রনায়ক বিখ্যাত সেনাপতি জুলিয়াস সীজার রোমের গর্ব বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখলো কার্পেট থেকে বেরিয়ে এসে তার সামনে দাড়িয়ে আছে অপরূপা সুন্দরী রানী ক্লিওপেট্রা।তার সেই স্বর্গীয় রূপসুধায় মুগ্ধ সীজার মুহুর্তেই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন যা ছিল ক্লিওপেট্রার অন্যতম গোপন উদ্দেশ্য।
তার আকর্ষনকে কাজে লাগিয়ে ইজিপ্টের সিংহাসনের উপর তার দাবীর কথা জানালে সীজার দ্বাদশ টলেমীকে পরদিন তার সামনে হাজির হওয়ার জন্য ডেকে পাঠান। কিন্ত রাজা টলেমী ক্লিওপেট্রার ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে নিজেকে প্রতারিত মনে করে সীজারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে।আলেকজান্দ্রিয়ার এই ছয়মাস ব্যাপী যুদ্ধে রণকুশলী সীজারের কাছে সহজেই পরাজিত হয়ে পালাতে গিয়ে নীলনদে ডুবে মারা যায় অনভিজ্ঞ কিশোর রাজা দ্বাদশ টলেমী।যুদ্ধে আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত লাইব্রেরীর একাংশ সহ অনেক গুরুত্বপুর্ন স্হাপনা জ্বলেপুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল।
সীজারের সহযোগীতায় যুদ্ধে জয়লাভ করেন ক্লিওপেট্রা। এরপর তৎকালীন মিশরের রীতি অনুযায়ী তিনি এবার তার ১১ বছর বয়সী ছোটো ভাইকে বিয়ে করে সিংহাসনে আরোহন করেন। মিশরের সিংহাসন ছাড়াও ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে সীজার তাকে আরো কিছু এলাকা তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করে দেন।
ক্লিওপেট্রা
এক বছর পর ৪৭ খৃঃ পুঃ জুন মাসে ক্লিওপেট্রার সিজারিয়ান নামে একটি পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহন করেন। ক্লিওপেট্রা তাকে সীজারের সন্তান বলে দাবী করেন এবং তার আশা ছিল পুত্রসন্তানহীন রোমান অধিপতি সীজারের উত্তরাধিকারী তার ছেলেই হবে। কিন্ত সীজার সিজারিয়ানকে নিজ সন্তান হিসেবে অস্বীকার করে ভাগ্নে অক্টেভিয়াসকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। এতে ক্লিওপেট্রা মনক্ষুন্ন হলেও কোনো কথা বলেনি।
পরের বছর ৪৬ খৃঃ পুঃ এ সীজার আরও কিছু সফল অভিযান শেষ করে রোমে ফিরে গেলে রোমের অধিবাসীরা তাকে বিরাট সম্বর্ধনা দেয়ার আয়োজন করেন।
সীজারের আমন্ত্রনে ক্লিওপেট্রা মিশরের ঐতিহ্যবাহী ডিজাইনে নির্মিত স্বর্নমন্ডিত সিংহাসন আকৃতির রথে চেপে অত্যন্ত জমকালো সাজে সেজে ছেলে সিজারিয়ান সহ সেই অনুষ্ঠানে উপস্হিত হন। তার সেই অতুলনীয় রূপ-সৌন্দর্য এবং ঐশ্বর্য আর বৈভবের সেই জমকালো উপস্হিতি সবাইকে হতবিহ্ববল করে তোলে।
সীজার ক্লিওপেট্রাকে রোমের অদুরে এক প্রাসাদে থাকার ব্যবস্হা করে দেন। তার প্রতি বিবাহিত সীজারের এই অনুরাগ ও পক্ষপাতিত্ব রোমের রক্ষনশীল সমাজের একটি অংশ পছন্দ করতে পারেনি। এছাড়াও
সীজারের প্রচন্ড ক্ষমতাশালী হয়ে উঠা ও নিজেকে সারা জীবনের জন্য ডিক্টেটর ঘোষনা করায় সিনেটে অনেকেই তার প্রতি বিরূপ হয়ে উঠে। যার ফলশ্রুতিতে দুই বছর পর ৪৪ খৃঃ পুঃ ১৫ ই মার্চ সিনেট ভবনের বাইরে সীজারকে তারই এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং রোম সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় ভবিষ্যত উত্তরাধিকারী ব্রুটাস ও তার সহযোগী ষড়যন্ত্রকারীরা ছুরিকাঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করে।
উল্লেখ্য যে এই ব্রুটাস নামটি থেকেই ইংরেজী ব্রুট শব্দটির উৎপত্তি।
এ ঘটনার পরই ক্লিওপেট্রা তার সন্তানসহ মিশরে পালিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পর তার ভাই তথা স্বামী ত্রয়োদশ টলেমীর রহস্যজনক মৃত্যু হলে ক্লিওপেট্রা তার ছেলে সিজারিয়ানকে সাথী করে সিংহাসনে বসেন।
ক্লিওপেট্রা ও মার্ক এ্যন্টনী
ইতিহাসে লাইলী মজনু আর শিরি ফরহাদের মতই অমর হয়ে আছে ক্লিওপেট্রা আর মার্ক এ্যন্টনীর প্রেম। মার্ক এ্যন্টনী ল্যাটিন ভাষায় যার নাম মার্কাস এ্যন্টোনিয়াস রোমের একজন বিখ্যাত সেনাপতি ও রাজনীতিবিদ। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও তিনি ছিলেন সীজারের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সমর্থক। সীজারের মৃত্যুর পর অক্টেভিয়াস ও লিপিডাসের সাথে যৌথভাবে রোমের শাসন ক্ষমতা লাভ করেন মার্ক এ্যন্টনী।
কৌশলগতভাবে ইজিপ্ট তখনও স্বাধীন ছিল যখন ভুমধ্যসাগরের তীরবর্তী সমস্ত এলাকাই ছিল রোমের শাসনাধীনে। এর মধ্যে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে তা হলো ক্লিওপেট্রা সীজারের এক হত্যাকারী ক্যাসিয়াসকে সহায়তা করছে।
শিল্পীর তুলিতে আঁকাএক ভোজসভায় এ্যন্টনী ও ক্লিওপেট্রা
এ অবস্থায় ৪২ খৃঃ পুঃ ক্লিওপেট্রার আনুগত্য সম্পর্কে জানার জন্য এ্যন্টনী তাকে ভুমধ্যসাগরের তীরবর্তী নগরী টরসাসে (আধুনিক তুরস্ক) দেখা করার আমন্ত্রন জানান। ক্ষমতা আর সিংহাসনের প্রতি অপরিসীম লোভী ও নিষ্ঠুর ক্লিওপেট্রা একে একে তার পথের কাটা ভাইবোনগুলোকেও রেহাই দেয়নি।
সে জানতো বাকী দুজন শাসকের চেয়ে এ্যন্টনী অনেক ক্ষমতাশালী, তাকে হাত করতে পারলে তার সিংহাসন নিরুপদ্রব। সে আরও জেনে ছিল কূটনীতিতে এ্যন্টনীর সীমাবদ্ধতা এবং মদ ও নারীর প্রতি তার চরম আসক্তি ও দুর্বলতার কথা। এই দুর্বলতাগুলোকেই ব্যবহার করার লক্ষ্য নিয়ে ক্লিওপেট্রা এ্যন্টনীর সাথে টরসাসে দেখা করা সিদ্ধান্ত নেয়।
শিল্পীর তুলিতে আঁকা এ্যন্টনী ও ক্লিওপেট্রা।
কাঠের অপরূপ কারুকাজ করা সোনালী রঙের নৌকায় বেগুনী পাল, তাতে সুরের ছন্দে ছন্দে রুপার বৈঠা বেয়ে নদী পথে নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে এ্যন্টনীর শিবিরের দিকে। সে নৌকায় স্বর্নের পোশাক আর অলংকারে প্রেমের দেবী আফ্রোদীতির সাজে সেজে বসে আছেন অবর্ননীয় রুপের অধিকারী ক্লিওপেট্রা। তার দুপাশে দুজন কিশোর প্রেমের দেবতা কিউপিডের সাজে সেজে পাখার বাতাস বুলিয়ে যাচ্ছে।আর সহচরীরা রয়েছে জলপরীর সাজে বিভিন্ন কাজের ব্যস্ততার ভঙ্গীমায়।ভেনাসরূপী ক্লিওপেট্রার সেই স্বর্নখচিত রাজকীয় বেশভুষা অভুতপুর্ব সেই সুগন্ধীর ঘ্রান আর উপস্হানার প্রকাশভঙ্গী যা মুহুর্তেই এ্যন্টনীকে তার প্রেমে মাতাল করে তুল্লো...
শিল্পীর তুলিতে আঁকা টরসাসে ক্লিওপেট্রা
বেগুনী পাল তুলে সোনালী রংয়ের নৌকায়, রুপার বৈঠা বেয়ে ভেনাস তথা মিশরের প্রেমের দেবী আইসিস সাজে সেজে ক্লিওপেট্রা সিডনাস(cydnus) নদী বেয়ে এ্যন্টনীর শিবিরে উপস্হিত হলেন। তার সেই অতুলনীয় রূপরাশি আর ঐশ্বর্যের সাথে তার বর্ণাঢ্য উপস্হিতিতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়লেন সোনালী চুল আর সমুদ্র নীল চোখের অধিকারী প্রেমের দেবতা ব্যাকাস রূপী রোমের বিখ্যাত সেনাপতি মার্ক এ্যন্টনী। দুজনের চোখে চোখ পড়া মাত্র তারা একে অপরের প্রেমে পরে গেলেন, যাকে বলা যায় প্রথম দর্শনেই প্রেম।
সেখানে এ্যন্টনী ক্লিওপেট্রাকে ডিনারে আমন্ত্রন জানালে ক্লিওপেট্রা ক্লান্তির অজুহাতে তা প্রত্যাখান করে উল্টো তাকেই আমন্ত্রন জানান তার সাথে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। সেই বিলাশ বহুল ডিনার পার্টিতে ক্লিওপেট্রা তার স্বর্নের তৈরী খাবার প্লেট বাসন ও পান পাত্র এবং দামী ও সুস্বাদু খাবার ছাড়াও দামী মদ পরিবেশন করে এ্যন্টনীকে চমকে দিতে সক্ষম হয়। যা ছিল তার পরিকল্পনার একটি অংশ।
নৈশভোজে এ্যন্টনী ও ক্লিওপেট্রা
৪১ খৃঃ পুঃ থেকে ৪০ খৃঃ পুঃ পর্যন্ত এক বৎসর ক্লিওপেট্রা আর এ্যন্টনী সেখানে এক সাথে বসবাস করেন। তাদের ভালোবাসার ফসল হিসেবে এক বছর পর ক্লিওপেট্রা জমজ সন্তানের মা হন।
৪০ খৃঃ পুঃ এ্যন্টনী এ্যথেন্স ফিরে গেলে তার স্ত্রী ফুলভিয়া (Fulvia) মারা যান। এরপর তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী অক্টেভিয়াসের বোন অক্টেভিয়াকে বিয়ে করতে সম্মত হন। সেখানে তার একটি মেয়ে জন্মলাভ করে। ৩৭ খৃঃ পুঃ এ্যন্টনী ইজিপ্টে ক্লিওপেট্রার কাছে ফিরে আসেন এবং তার পরের বছর ক্লিওপেট্রাকে মিশরীয় রীতি অনুযায়ী বিয়ে করেন। সে বছরই তাদের আরেকটি ছেলে জন্ম গ্রহন করে, তার নাম রাখা হয় টলেমী ফিলাডেলফাস।
ক্লিওপেট্রা আলেকজান্দ্রিয়া ফিরে গেলে এ্যন্টনী টলেমী সাম্রাজ্যের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া জায়গাগুলো উদ্ধার করতে সফল হন। এর মধ্যে ছিল সাইপ্রাস এবং লেবাননের কিছু অংশ। অভিযান শেষে এ্যন্টনী ক্লিওপেট্রার কাছে ফিরে এসে সীজারিয়ানকে জুলিয়াস সীজারের ছেলে এবং তাকে ক্লিওপেট্রার সাথে যৌথ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তিনি তার বিজিত রাজ্যগুলো তাদের ছেলে মেয়েদের মধ্যে রোম সাম্রাজ্যের তরফ থেকে উপঢৌকন হিসেবে ভাগ করে দেন।
সন্তানদের এ্যন্টনীর উপহার
এ্যন্টনী আলেকজান্দ্রিয়াতেই বসবাস শুরু করলে রোমে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ক্লিওপেট্রার সাথে তার ঘনিষ্ঠতা, তাকে বিয়ে করে সন্তানের পিতা হওয়া এবং জয়লাভ করা দেশ গুলো মিশরকে উপহার দেয়া ব্যাপারগুলো এ্যন্টনীর আনুগত্য সম্পর্কে অক্টেভিয়ানের মধ্যে প্রচন্ড সন্দেহের সৃষ্টি করে।
তারই ফলশ্রুতিতে ৩১ খৃঃ পুঃ আইওনিয়ান সমুদ্রের উপকুলে এক্টিয়ামে উভয় পক্ষ মুখোমুখি অবস্হান নেয়।স্হলযুদ্ধে পারদর্শী এ্যন্টনী ক্লিওপেট্রার অনুরোধে নৌযুদ্ধে অবতীর্ন হয়। তাদের দুজনের ৫০০ জাহাজ এবং ৭০ হাজার সৈন্য অক্টেভিয়ানের ৪০০ জাহাজ আর ৮০ হাজার সৈন্যের মুখোমুখি হয়। ভালো অবস্হানে থেকেও যুদ্ধের এক পর্যায়ে এ্যন্টনী কিছুটা বিপর্যয়ের সন্মুখীন হলে পেছনে থাকা ক্লিওপেট্রা তার সৈন্যদের নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। এ্যন্টনীও এসময় তার সৈন্যদের শত্রুর মুখে ফেলে ক্লিওপেট্রাকে অনুসরন করতে থাকে। ফলে অক্টেভিয়ান খুব সহজেই যুদ্ধে জয়লাভ করে। এরপর দু একটি ছোটোখাটো স্হল যুদ্ধে জয় লাভ করলে পুরোপুরি ভাবেই আলেকজান্দ্রিয়ার পতন ঘটে।
বিখ্যাত এ্যক্টিয়ামের যুদ্ধ
বহু যুদ্ধের বিজয়ী বিখ্যাত বীর রোমান সেনাপতি মার্ক এ্যন্টনী ক্লান্ত, বিদ্ধস্ত এবং জীবনে প্রথম পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে আসেন আলেকজান্দ্রিয়ায়। ফিরে এসেই সে খবর পায় তার ভুবনবিখ্যাত রূপের রানী প্রিয়তমা স্ত্রী ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যা করেছে। এই মর্মান্তিক খবরে নিজেকে আর স্হির রাখতে না পেরে এ্যন্টনী নিজ তরবারী দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে । কিন্ত মৃত্যুর আগে সে জানতে পারে ক্লিওপেট্রা বেচে আছে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়িয়ে আহত অবস্থাতেই সে প্রেয়সী স্ত্রীর সাথে শেষ দেখা করার ইচ্ছা পোষন করলে তাকে ক্লিওপেট্রার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
মুমুর্ষ এ্যন্টনী তাকে অক্টেভিয়ানের সাথে একটি সমঝোতায় আসার জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেন। এর কিছুক্ষন পরেই সে ক্লিওপেট্রার হাতের উপরেই তার শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন।এরই সাথে শেষ হয়ে গেলো এক ঐতিহাসিক প্রেমের করুন অধ্যায়।
এ্যান্টনীর অনুরোধে ক্লিওপেট্রা ইজিপ্টের সিংহাসনের উপর তার সন্তানদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অক্টেভিয়ানের শিবিরে কয়েকবার দুত পাঠান। কিন্ত অক্টেভিয়ান তার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। অক্টেভিয়ানের হাতে লান্ছিত ও অপমানিত হওয়ার আশঙ্কায় শেষপর্যন্ত ক্লিওপেট্রাও স্বেচ্ছা মৃত্যুকে বেছে নিলেন ।
তিনি তার নিজের জন্য নির্মিত সমাধিসৌধে সমস্ত ধন সম্পদ এবং বিশ্বস্ত দুই সহচরীকে নিয়ে স্বর্নমন্ডিত পোষাক আর অলংকারে অবর্ননীয় ও অপরূপ সাজে সেজে শেষ শয্যায় শায়িত হন। বলা হয়ে থাকে নীলনদের এক ধরনের প্রচন্ড বিষাক্ত ছোটো ছোটো ভাইপার জাতীয় সাপের কামড়ে তার ও সহচরীদের মৃত্যু হয়েছিল যা সে নিজেই ডুমুরের ঝুড়িতে করে লুকিয়ে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে । আবার কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন অত ছোটো সাপের কামড়ে তিনটি পুর্ন বয়স্ক মানুষের মৃত্যু হতে পারেনা, কেউটে সাপের বিষ ছিলই তাদের মৃত্যুর কারণ।
সাপের কামড়ে ক্লিওপেট্রার আত্মহত্যা
ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর পর তার পলাতক বড় ছেলে সিজারিয়ানকে ধরে এনে অক্টেভিয়ানের নির্দেশে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ্যন্টনীর ঔরসজাত বাকী তিন সন্তানকে অপমানজনকভাবে রোমের রাস্তায় সবার চোখের সামনে দিয়ে সোনার শিকল পায়ে হাটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এ্যন্টনীর স্ত্রী পালক হিসেবে তাদেরকে গ্রহন করেন।
এরপর ইতিহাসে সেই ছেলেদের আর কোনো খোজ পাওয়া যায়নি। শুধু মেয়েটি আফ্রিকার কোনো এক অখ্যাত রাজাকে বিয়ে করে এটুকু জানা যায়।
অর্থাৎ ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর সাথে সাথেই মিশরে টলেমি বংশের তথা বিখ্যাত ফারাওদের দীর্ঘ গৌরবময় শাসনের অবসান ঘটে। ফলে পৃথিবীতে সভ্যতার অন্যতম সুচনাকারী ও পরাক্রমশালী স্বাধীন দেশ ইজিপ্ট রোম সাম্রাজ্যের একটি সামান্য প্রদেশে পরিনত হয় মাত্র।
পরবর্তী যুগে কিছু কিছু ঐতিহাসিক রোমান দৃষ্টভঙ্গীতে ক্লিওপেট্রাকে দুঃশ্চরিত্রা, স্বার্থপর,যাদুবিদ্যা তথা ডাকিনী বিদ্যায় পারদর্শিনী, কুটকৌশলী, ধন-সম্পদ ও ক্ষমতালোভী ইত্যাদি বিশেষনে ভুষিত করতে কার্পন্য করেনি।বিখ্যাত রোমান কবি হোরাস তাকে পাগল এবং লুকান তাকে ইজিপ্টের লজ্জা বলে অভিহিত করেছে।
রোমানদের উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হওয়ার পর, বিখ্যাত ঐতিহাসিক প্লুটার্ক তাকে এ্যন্টনীর একনিষ্ঠ প্রেমিক এবং ট্র্যাজিক নায়িকা হিসেবে উপস্হাপন করেছেন।
ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্য নিয়েও বহু মতবাদ প্রচলিত আছে।বলা হয়ে থাকে যত সুন্দরী তাকে বলা হয়ে থাকে তত সে সুন্দরী সে ছিলনা। তবে প্লুটার্কের ভাষায় 'যে কোনো স্হানে ক্লিওপেট্রার উপস্হিতি ছিল অপ্রতিরোধ্য। সে যা করতো সেটা ছিল যাদুস্পর্শী। আর তার কথা বলার ভঙ্গীমা তার কাজল বরণ চোখের চেয়েও আকর্ষনীয় ছিল'।
ক্লিওপেট্রা ছিলেন বহুমাত্রিক চরিত্রের অধিকারী, পৃথিবীতে যার আবির্ভাব একবারই মাত্র হয়েছিল।
প্যাপিরাসে আকা প্রাচীন শিল্পকর্ম।
তথ্য ও ছবি নেট।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন